পরিপাকগ্রন্থি কী?
যে সকল গ্রন্থির ক্ষরণ সরাসরি খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে সে সকল গ্রন্থিসমূহকে বলা হয় “পরিপাকগ্রন্থি”।
মানুষের পরিপাক গ্রন্থিগুলােকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- পরিপাক নালির বাইরে অবস্থিত কিন্তু পরিপাক নালির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত গ্রন্থি, যেমন- লালাগ্রন্থি, যকৃত ও অগ্ন্যাশয়।
পরিপাক নালির ভেতরের অংশের গ্রন্থি, যেমন- গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি ও আন্ত্রিক গ্রন্থি। নিম্নে মানুষের পরিপাক গ্রন্থির গঠন, অবস্থান ও কাজের বর্ণনা দেয়া হলাে।
লালাগন্থি (Salivary gland)
পরিপাকে অংশগ্রহণকারী যে গ্রন্থি থেকে লালা ক্ষরিত হয় তাকে লালা গ্রন্থি বলে।

মুখের দু’পাশে তিন জোড়া লালাগ্রন্থি আছে। যথা-
গ্রন্থির নাম | অবস্থান | সংখ্যা | প্রকৃতি |
প্যারােটিড | কানের নিচে | ১ জোড়া | বহুকোষী |
সাবম্যান্ডিবুলার | নিচের চোয়ালের ভেতর দিকে | ১ জোড়া | বহুকোষী |
সাবলিঙ্গুয়াল | জিহ্বার তলায় | ১ জোড়া | এককোষী |
লালাগন্থির গঠন
লালাগ্রন্থি এপিথেলিয়ামে আবৃত এবং ডিম্বাকার রস নিঃসারী থলি দ্বারা গঠিত। প্রত্যেক থলির কেন্দ্রে একটি নালিকা থাকে। এগুলাে একীভূত হয়ে ক্রমে গ্রন্থির মূল নালিতে পরিণত হয় এবং পরে মুখবিবরে প্রবেশ করে। গ্রন্থিগুলাে দু’রকম কোষ দ্বারা গঠিত, যেমন- সেরাস কোষ ও মিউকাস কোষ। লালাগ্রন্থির এ সেরাসকোষ থেকে এনজাইম ও মিউকাস কোষ থেকে মিউকাস নিঃসৃত হয়।
লালাগন্থির কাজ
- ১।লালা রসের প্রধান কাজ হচ্ছে খাদ্যকে পিচ্ছিল করে তা চিবাতে ও গিলতে সাহায্য করা।
- ২। টায়ালিনের মাধ্যমে সিদ্ধ শ্বেতসারকে ভেঙ্গে দ্বিশর্করা-মলটোজে এবং মলটেজ এনজাইম দিয়ে মলটোজকে গ্লুকোজে পরিণত করা।
যকৃত (Liver)
মানুষের মধ্যচ্ছদার ঠিক নিচে পাকস্থলির ডানদিকে বিস্তৃত গাঢ় লালচে বর্ণের ত্রিকোণাকার ও পিত্তরস নিঃসরণকারী গ্রন্থিকে যকৃত বলা হয়। যকৃতের বেশির ভাগ অংশ দেহের ডানদিকে অবস্থিত। যকৃত মানবদেহের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ গ্রন্থি। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের যকৃতের ওজন প্রায় ১.৫-২.০ কেজি।

এটি চারটি অসম্পূর্ণ খণ্ড নিয়ে বিভক্ত। ডান খণ্ডটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং এই খণ্ডের নিচে পেয়ালার মতাে পিত্তরস ধারণকারী একটি থলে থাকে, একে পিত্তথলি বলে। পিত্তথলি ৭-৮ সে.মি. লম্বা। পিত্তথলি থেকে পিত্ত ডিওডেনামে উন্মুক্ত হয়। পিত্তরস। হলদে সবুজ বর্ণের একটি ক্ষার জাতীয় তরল পদার্থ। এতে শতকরা ৮০% পানি ও ২০% অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান থাকে।
যকৃতের কাজ
১।যকৃত থেকে ক্ষরণকৃত পিত্তরসে, খাদ্য পরিপাকে সাহায্যকারী কোন এনজাইম না থাকায় খাদ্য পরিপাকে এদের প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা নেই। তবে এরা শর্করা, প্রােটিন, ভিটামিন প্রভৃতি খাদ্যকে পরিপাকের পর রক্তস্রোতে পরিবাহিতকরণে সাহায্য করে।
অগ্ন্যাশয় (Pancreas)
অগ্ন্যাশয় পাকস্থলির নিচে উদরীয় গহ্বরের ডিওডেনামের দুটি বাহুর মাঝ অংশে গােলাপি বর্ণের এবং অনিয়মিত আকৃতির একটি মিশ্র গ্রন্থি। দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ সে. মি.। অগ্নাশয়ের সম্মুখ ভাগ প্রশস্ত কিন্তু পশ্চাৎ ভাগ ক্রমশ সরু। অগ্ন্যাশয়ে দু’ধরনের গ্রন্থি আছে। যথা- ক. অন্তঃক্ষরা (হরমােন ক্ষরণকারী) গ্রন্থি ও খ. বহিঃক্ষরা (এনজাইম নিঃস্রাবী) গ্রন্থি।

ক. অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি
অগ্ন্যাশয়ের মধ্যে লােবিউলগুলাের ফাঁকে ফাঁকে আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহান্স নামক হরমােনগ্রন্থি থাকে। এই হরমােন গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন, গ্লুকাগন, গ্যাস্ট্রিন ও সােমাটোস্ট্যাটিন হরমােন ক্ষরিত হয়, যা দেহের নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইনসুলিন ও গ্লুকাগন হরমােন রক্তে শর্করার বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে।
খ. বহিঃক্ষরা গ্রন্থি
অগ্নাশয়ের মধ্যে কতকগুলাে এনজাইম নিঃস্রাবী ও নালিযুক্ত গ্রন্থি থাকে, এদেরকে এসিনাই বলে। এরা লােবিউল গঠন করে এবং লােবিউল থেকে ছােট ছােট নালিকা বের হয়ে একত্রিত হয়ে ‘উইরসাং’ নালি গঠন করে। এই উইরসাং নালি অগ্ন্যাশয়ের দৈর্ঘ্য বরাবর ডিওডেনামের কাছে অভিন্ন পিত্তথলির সাথে মিলিত হয়ে অ্যাম্পুলার মাধ্যমে ডিওডেনামে উন্মুক্ত হয়। অগ্ন্যাশয় থেকে এ নালির মাধ্যমে ক্ষরিত রসকে অগ্নাশয়িক রস বলে। অগ্ন্যাশয় রসে প্রােটিন,শর্করা ও লিপিড বা ফ্যাট পরিপাককারী এনজাইম থাকে যা খাদ্য পরিপাকে সহায়ক।
পাকস্থলি গ্রন্থি (Digestive gland)
পাকস্থলির অন্তঃপ্রাচীরের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য গ্রন্থিকোষ রয়েছে। এগুলাে পরিপাকে সহায়ককারী গ্রন্থিকোষ সাহায্য করে। এসব কোষ থেকে পাচক রস নামে বর্ণহীন ও তীব্র অমধর্মী তরল পদার্থ নিঃসৃত হয়। এ ক্ষরণ খাদ্যের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। পাচক রসে প্রােটিন ও স্নেহজাতীয় খাদ্য পরিপাককারী এনজাইম থাকে। এছাড়া অপরিপাকীয় খাদ্য পিচ্ছিলকরণ, পাকস্থলির প্রাচীরকে রক্ষা করা, জীবানুনাশ, অক্ষারের সমতা রক্ষা করা এবং হরমােন ক্ষরণ ইত্যাদি কার্যগুলাে উল্লেখযােগ্য।
আন্ত্রিক গ্রন্থি
ক্ষুদ্রান্ত্রের অন্তঃপ্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য পরিপাকীয় গ্রন্থিকোষ অবস্থিত। এগুলাে ক্ষরণে আন্ত্রিক রসের সৃষ্টি হয়, যেখানে বিভিন্ন এনজাইম থাকে। এগুলাে স্টার্চ, ডেক্সট্রিন, প্রােটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্যকে পরিপাকে সহায়তা করে। এছাড়া হরমােন ক্ষরণ করে খাদ্য পরিপাক, শােষণ ও পানি সাম্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে।