মাইটোসিস কোষ বিভাজন এর সংজ্ঞা
যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি প্রকৃতকোষের নিউক্লিয়াস এবং ক্রোমোসোম উভয়ই একবার করে বিভক্ত হয় তাকে মাইটোসিস কোষ বিভাজন বলা হয়।
মাইটোসিস কোথায় ঘটে?
প্রাণী ও উদ্ভিদের বিভাজন ক্ষমতাসম্পন্ন দৈহিক কোষে মাইটোসিস কোষ বিভাজন ঘটে। জনন মাতৃকোষে মাইটোসিস ঘটে না। প্রকৃত নিউক্লিয়াসযুক্ত (উন্নত জীব কোষ) দেহকোষ মাইটোসিস পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়। উদ্ভিদের বর্ধনশীল অংশ যথা কাণ্ড ও মূলের অগ্রভাগ, ভ্রূণ মুকুল, ভ্রূণ মূল, পুষ্পমুকুল, অগ্রমুকুল, বর্ধনশীল পত্র ইত্যাদির ভাজক টিস্যুর কোষ এ প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়। প্রাণীর স্নায়ুকোষ ছাড়া সকল দেহকোষও এ প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়।
মাইটোসিস আবিষ্কার
শ্লাইখার (১৮৭৯) লক্ষ করেন, একটি দেহকোষীয় নিউক্লিয়াস বিভক্ত হয়ে দুটি অনুরূপ নিউক্লিয়াসে পরিণত হয় এবং তিনি এর নাম দেন ক্যারিওকাইনেসিস। পরবর্তীতে ওয়াল্টার ফ্লেমিং (১৮৮২) এ প্রকার বিভাজনকে মাইটোসিস নামে অভিহিত করেন।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের বৈশিষ্ট্য
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের উল্লেযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলো হলো-
- মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ক্রোমোসোম লম্বালম্বিভাবে দুটি ক্রোমাটিডে বিভক্ত হয়।
- প্রতিটি ক্রোমাটিড তার নিকটস্থ মেরুতে পৌঁছে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস সৃষ্টির মাধ্যমে দুটি অপত্য কোষে
- পরিণত হয়।
- অপত্য কোষগুলো মাতৃকোষের সমগুণসম্পন্ন হয়।
- অপত্য কোষের ক্রোমোসোম সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোসোম সংখ্যার সমান থাকে।
- অপত্য কোষগুলো বৃদ্ধি পেয়ে এক সময় মাতৃকোষের সমান আয়তনবিশিষ্ট হয়।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের ধাপ
মাইটোসিস কোষ বিভাজন দুটি প্রধান ধাপে বিভক্ত যথা- ক্যারিওকাইনেসিস ও সাইটোকাইনেসিস। ক্যারিওকাইনেসিস হলো নিউক্লিয়াসের ভিভাজন। সাইটোকাইনেসিস হলো সাইটোপ্লাজমের বিভাজন। ক্যারিওকাইনেসিস প্রক্রিয়াকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
- প্রোফেজ পর্যায়
- প্রোমেটাফেজ পর্যায়
- মেটাফেজ পর্যায়
- অ্যানাফেজ পর্যায়
- টেলোফেজ পর্যায়।
প্রোফেজ (Prophase) বা আদ্যপর্যায়
(গ্রিক শব্দ pro = প্রাক + phase = পর্যায় বা দশা)মাইটোসিস-এর প্রথম পর্যায়কে প্রোফেজ বলে। এটি মাইটোসিসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়। প্রোফেজ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য-
- এ পর্যায়ে কোষের নিউক্লিয়াস আকারে বড় হয়।
- নিউক্লিয়াস, বিশেষ করে ক্রোমোসোমগুলোতে জল-বিয়োজন (dehydration) আরম্ভ হয়।
- ক্রমাগত জল-বিয়োজনের ফলে ক্রোমোসোমগুলো সংকুচিত হতে থাকে, ফলে ক্রোমোসোমগুলো ক্রমাগত খাটো ও মোটা হয়, রং ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং স্পষ্ট হতে স্পষ্টতরভাবে দৃষ্টিগোচর হয়।
- এ পর্যায়ের শেষের দিকে নিউক্লিয়োলাস এবং নিউক্লিয়ার এনভেলপের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে।
- সাইক্লিন ডিপেনডেন্ট কাইনেজ (Cdk) কর্তৃক কতক প্রোটিনের ফসফোরাইলেশনের কারণে ক্রোমোসোমের সংকোচন শুরু হয় এবং কতক প্রোটিনের ফসফোরাইলেশনের কারণে নিউক্লিয়ার এনভেলপের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে।
- মাইটোসিস কোষ বিভাজনের প্রোফেজ পর্যায়ে প্রতিটি ক্রোমোসোম সেন্ট্রোমিয়ার ব্যতীত লম্বালম্বিভাবে (অনুদৈর্ঘ্যে) দুটি সূত্রে বিভক্ত থাকে।
- প্রতিটি সূত্রকে ক্রোমাটিড বলা হয়।
- ক্রোমোসোমগুলো প্রোফেজ পর্যায়ে ক্রোমাটিডে বিভক্ত হলেও আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রে সাধারণত অবিভক্তই মনে হয়।
- এ পর্যায়ে স্পিন্ডল তন্তু সৃষ্টির সূচনা ঘটে।

প্রো-মেটাফেজ (Pro-metaphase) বা প্রাক-মধ্যপর্যায়
(গ্রিক শব্দ pro = প্রাক + meta = মধ্য + phase পর্যায় বা দশা) প্রোফেজ পর্যায়ের পরবর্তী এবং মেটাফেজ পর্যায়ের অগ্রবর্তী পর্যায়কে প্রো-মেটাফেজ বলে। এটি স্বল্পস্থায়ী পর্যায়। প্রো-মেটাফেজ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য-
- প্রোফেজের একেবারে শেষদিকে উদ্ভিদকোষে কতগুলো তত্ত্বময় প্রোটিনের সমন্বয়ে দু’মেরুযুক্ত স্পিন্ডল যন্ত্রের (spindle apparatus) সৃষ্টি হয়।
- এই পর্যায়ের প্রথম দিকেই স্পিন্ডল যন্ত্রের তন্তুগুলোর আঘাতে নিউক্লিয়ার এনভেলপ বিলুপ্ত হতে থাকে এবং এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
- এই পর্যায়ে নিউক্লিয়োলাসেরও বিলুপ্তি ঘটে।
- প্রো-মেটাফেজ পর্যায়ে উদ্ভিদ কোষে তত্ত্বময় প্রোটিন সমন্বয়ে গঠিত স্পিন্ডল যন্ত্রের সৃষ্টি হয়।
- স্পিন্ডল যন্ত্রের দু’মেরুর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে ইকুয়েটর বা বিষুবীয় অঞ্চল বলা হয়। স্পিন্ডল যন্ত্রের তন্ত্রগুলো এক মেরু হতে অপর মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। এদেরকে স্পিন্ডল ফাইবার (spindle fibre) বলা হয়।
- প্রো-মেটাফেজ পর্যায়ে ক্রোমোসোমের সেন্ট্রোমিয়ার স্পিন্ডল যন্ত্রের নির্দিষ্ট তন্তুর সাথে সংযুক্ত হয়।
- এসময় ক্রোমোসোম একটু আন্দোলিত হয় যাকে ক্রোমোসোমীয় নৃত্য বলা হয়ে থাকে। আসলে ক্রোমোসোমগুলো বিষুবীয় অঞ্চলের দিকে যেতে থাকে।
- ক্রোমোসোমের সেন্ট্রোমিয়ার সংযুক্তকারী তন্ত্রকে ট্র্যাকশন ফাইবার (traction fibre) বলা হয়।
- ক্রোমোসোমগুলো এ সময় বিষুবীয় অঞ্চলে বিন্যস্ত হতে থাকে। (প্রাণিকোষে স্পিন্ডল যন্ত্র সৃষ্টি ছাড়াও পূর্বে বিভক্ত সেন্ট্রিয়োল দু’মেরুতে অবস্থান করে এবং দুমেরু হতে অ্যাস্টার তন্তু বিচ্ছুরিত হয়।)
- স্পিন্ডল ফাইবার সেন্ট্রোমিয়ারের কাইনেটোকোরের মটর প্রোটিনে সংযুক্ত হয়। এই প্রোটিন ATP ভেঙ্গে ADP ও Pi সৃষ্টি করে এবং শক্তি নির্গত করে। এই শক্তি খরচ করে ক্রোমোসোম মাইক্রোটিউবিউল ধরে চলতে থাকে।

মেটাফেজ (Metaphase) বা মধ্যপর্যায়
(গ্রিক শব্দ meta = মধ্য + phase = পর্যায় বা দশা) মেটাফেজ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য-
- এ পর্যায়ের প্রথমেই সমস্ত ক্রোমোসোম স্পিন্ডল যন্ত্রের বিষুবীয় অঞ্চলে এসে অবস্থান করে।
- স্পিন্ডল যন্ত্রের দু’মেরুর মধ্যবর্তী স্থানকে বিষুবীয় বা নিরক্ষীয় অঞ্চল বলা হয়। কোষ বিভাজনের মেটাফেজ দশায় স্পিন্ডল যন্ত্রের বিষুবীয় অঞ্চলে ক্রোমোসোমের বিন্যস্ত হওয়াকে মেটাকাইনেসিস বলে।
- এ পর্যায়ে ক্রোমাটিডগুলো সবচেয়ে বেশি মোটা, খাটো ও স্পষ্ট দেখা যায়। ক্রোমোসোমের খাটো ও মোটা হওয়াকে বলা হয় কন্ডেনসেশন (Condensation)। একটি অতিমাত্রায় কয়েলিং (coiling) প্রক্রিয়ায় এটি হয়ে থাকে তাই একে বলা হয় সুপার কয়েলিং।
- এ পর্যায়ে কোষে ক্রোমোসোম সংখ্যা, আকার ও আকৃতি নির্ণয় করা যায়। নিউক্লিয়ার এনভেলপ ও নিউক্লিয়োলাস সম্পূর্ণ বিলুপ্ত থাকে।
- মেটাফেজ পর্যায়ের শেষ ভাগে প্রতিটি সেন্ট্রোমিয়ার সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্য সেন্ট্রোমিয়ার সৃষ্টি করে।
অ্যানাফেজ (Anaphase) বা গতিপর্যায়
(গ্রিক শব্দ ana = গতি + phase = পর্যায় বা দশা)
অ্যানাফেজ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য-
- মাইটোসিসের প্রো-মেটাফেজ ও মেটাফেজ পর্যায় পর্যায়ের প্রথমেই প্রত্যেকটা ক্রোমোসোমের সেন্ট্রোমিয়ার দু’ভাগে বিভক্ত হয় ফলে দুটি সেন্ট্রোমিয়ারের সৃষ্টি হয় এবং ক্রোমাটিড দুটি আলাদা হয়ে পড়ে।
- এ অবস্থায় প্রতিটি ক্রোমাটিডকে অপত্য ক্রোমোসোম বলা হয় এবং এদের প্রত্যেকের একটি করে সেন্ট্রোমিয়ার থাকে।
- এ সময় অপত্য ক্রোমোসোমগুলোর মধ্যে বিকর্ষণ শক্তি বৃদ্ধি পায় ফলে এরা বিষুবীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে যায়।
- প্রত্যেকটা ক্রোমোসোমের অর্ধেক এক মেরুর দিকে এবং বাকি অর্ধেক অপর মেরুর দিকে যেতে থাকে।
- প্রত্যেক ক্রোমোসোমের মেরুর দিকে চলনের সময় সেন্ট্রোমিয়ার অগ্রগামী এবং বাহু অনুগামী হয়।
- অপত্য ক্রোমোসোমগুলো মেরুর কাছাকাছি পৌঁছালেই অ্যানাফেজ বা গতি পর্যায়টি শেষ হয়।
- এ সময় ক্রোমোসোমের প্যাঁচ খুলে এরা দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

টেলোফেজ পর্যায়
(গ্রিক শব্দ Telo = শেষ + phase = পর্যায় বা দশা) টেলোফেজ হলো মাইটোসিস কোষ বিভাজনের শেষ পর্যায় এবং এতে যে সব পরিবর্তন দেখা যায় তা প্রোফেজ পর্যায়ে যে সব ঘটনা ঘটে তার ঠিক বিপরীত অবস্থা। টেলোফেজ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য-
- অপত্য ক্রোমোসোমগুলো বিপরীত মেরুতে এসে পৌঁছায়।
- ক্রোমোসোমগুলোতে পুনরায় পানিযোজন অর্থাৎ Hydration শুরু হয়। এ সময় ক্রোমোসোমগুলো প্রসারিত হয় ফলে ক্রোমোসোমগুলো সরু ও লম্বা হতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে অদৃশ্য হয়।
- এ সময় ক্রোমোসোমগুলো জড়িয়ে নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম গঠন করে এবং নিউক্লিয়োলাসের পুনঃআবির্ভাব ঘটে।
- নিউক্লিয়ার রেটিকুলামকে ঘিরে পুনরায় নিউক্লিয়ার এনভেলাপের সৃষ্টি হয় ফলে দু’মেরুতে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস গঠিত হয়।
- স্পিন্ডল ফাইবারগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।
সাইটোকাইনেসিস
টেলোফেজ পর্যায়ের শেষের দিকে সাইটোকাইনেসিস আরম্ভ হয়।
এ সময় বিষুবীয় তলে অবস্থানরত এন্ডোপ াজমিক জালিকার ছোট ছোট অংশগুলো জমা হয় এবং পরবর্তীতে মিলিত হয়ে কোষ প্লেট গঠন করে।
সাইটোপ্লাজমিক অঙ্গাণুসমূহের সুষম বণ্টন ঘটে ফলে দুটি অপত্য কোষ সৃষ্টি হয়। এভাবেই মাইটোসিস কোষ বিভাজন
সম্পন্ন হয়।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের গুরত্ব
জীবের জন্য মাইটোসিস কোষ বিভাজন অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। কারণ জীবদেহে এরা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন-
নিউক্লিয়াস ও সাইটোপাজমের ভারসাম্য রক্ষা
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের ফলে নিউক্লিয়াস ও সাইটোপাজমের ভারসাম্য রক্ষিত হয়। তাই কোষের স্বাভাবিক আকার, আকৃতি ও আয়তন বজায় থাকে।
দৈহিক বৃদ্ধি
মাইটোসিসের মাধ্যমে বহুকোষী জীবের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। ফলে এককোষী জাইগোট প্রথমে বহুকোষী ভ্রূণে পরিণত হয়। পরে ভ্রূণ থেকে একই প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ জীবের সৃষ্টি হয়।
ক্রোমোসোমের সমতা রক্ষা
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের ফলে মাতৃকোষের ক্রোমোসোম সংখ্যা অপত্য কোষেও বর্তমান থাকে। তাই ক্রোমোসোমের সমতা রক্ষিত হয়।
বংশবৃদ্ধি
এককোষী সুকেন্দ্রিক জীব মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করে। যেমন- Chlamydomonas
অঙ্গজ প্রজনন
মাইটোসিস এর ফলে অঙ্গজ প্রজনন সাধিত হয়।
ক্ষতস্থান পূরণ
জীবের কোন স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হলে সে স্থান পূরণ করতে মাইটোসিস কোষ বিভাজন অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
কোষের পুনরৎপাদন
জীবদেহে কিছু কিছু কোষ আছে যাদের আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট। এসব কোষ বিনষ্ট হলে মাইটোসিসের মাধ্যমে এদের পূরণ ঘটে।
জনন কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি
জনন কোষের সংখ্যাবৃদ্ধিতেও মাইটোসিস গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গুণগত স্থিতিশীলতা রক্ষা
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের ফলে একই ধরনের কোষের উৎপত্তি হয়। তাই জীব জগতের গুণগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মাইটোসিস গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
জননাঙ্গ সৃষ্টি
মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বহুকোষী জীবের জননাঙ্গ সৃষ্টি হয়, যা বংশবৃদ্ধির ক্রমধারা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
এভাবেই মাইটোসিস কোষ বিভাজন জীবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।