রক্তের গ্রুপ
রক্ত কণিকার প্লাজমামেমব্রেনে অবস্থিত বিভিন্ন অ্যান্টিজেনের উপস্থিতির ভিত্তিতে রক্তের শ্রেণিবিন্যাসকে রক্ত গ্রুপ (Blood Group) বলে।
আমেরিকার জীববিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার (Karl Landsteiner) ১৯০১ সালে মানুষের রক্তের শ্রেণিবিন্যাস করেন। রক্ত কণিকায় অ্যান্টিজেনের উপস্থিত ও অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে রক্তের যে শ্রেণিবিন্যাস করেন, তা ABO ব্লাড গ্রুপ নামে পরিচিত। অনেক সময় একে ল্যান্ডস্টেইনার এর ব্লাড গ্রুপ বলে।
অ্যান্টিজেন
লােহিত রক্ত কণিকার প্লাজমা মেমব্রেনে মিউকো পলিস্যাকারাইড জাতীয় পদার্থ যা অ্যান্টিবডি উৎপাদনের উদ্দীপনা যােগায় তাকে অ্যান্টিজেন বলে।
অ্যান্টিবডি
অ্যান্টিবডি হচ্ছে দেহে বহিরাগত পদার্থের প্রতি সাড়া দিয়ে প্লাজমা কোষ (B-লিম্ফোসাইট) থেকে উৎপন্ন প্রােটিনধর্মী পদার্থ যা অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অ্যান্টিজেনকে নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করে। অ্যান্টিবডি থাকে প্লাজমা প্রােটিন রূপ যে অ্যান্টিবডির সঙ্গে অ্যান্টিজেন বিক্রিয়ায় রক্ত জমাট বেঁধে যায় তাকে অ্যাগ্লুটিনিন বলে।
ABO- ব্লাড গ্রুপ
মানুষের রক্তে A ও B-এ দু’ধরনের অ্যান্টিজেন থাকতে পারে। অ্যান্টিজেন A ও B-র সাথে রক্ত রসে কতকগুলাে স্বতঃস্ফুর্ত অ্যান্টিবডি রয়েছে। এগুলােকে Ante A এবং Ante B বলে। বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার মানুষের রক্তের শ্রেণিবিন্যাস করে তা A, B, AB, এবং O এ ৪ টি গ্রুপের নামকরণ করেন। অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতির ভিত্তিতে এসকল ব্লাড গ্রুপকে এভাবে বর্ণনা করা যায়-
A-রক্ত গ্রুপ
যে রক্তের লোহিত কণিকার গাত্রে A অ্যান্টিজেন ও রক্তরসে b অ্যান্টিবডি থাকে তাকে A গ্রুপের রক্ত বলে।
B-রক্ত গ্রুপ
যে রক্তের লোহিত কণিকার গাত্রে B অ্যান্টিজেন ও রক্তরসে a অ্যান্টিবডি থাকে তাকে B গ্রুপের রক্ত বলে।
AB-রক্ত গ্রুপ
যে রক্তের লোহিত কণিকার গাত্রে A ও B উভয় অ্যান্টিজেন থাকে কিন্তু রক্তরসে কোন অ্যান্টিবডি থাকে না। তাকে AB গ্রুপের রক্ত বলে।
O-রক্ত গ্রুপ
যে রক্তের লোহিত কণিকার গাত্রে A ও B উভয় অ্যান্টিজেন থাকে না ও রক্তরসে a ও b উভয় অ্যান্টিবডি থাকে তাকে O গ্রুপের রক্ত বলে।

রক্ত আদান প্রদান
কোনো রক্তগ্রুপের কণিকায় অ্যান্টিজেন এবং তার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অ্যান্টিবডিযুক্ত প্লাজমার মধ্যে বিক্রিয়া ঘটলে লোহিত রক্ত কণিকাগুলো জমাট বেঁধে যায়। ফলে রক্তগ্রহীতার মৃত্যু ঘটে। A গ্রুপের অ্যান্টিবডি B রক্ত গ্রুপের লোহিত কণিকাকে জমাট বেঁধে দেয়। ঠিক তেমনি B গ্রুপের অ্যান্টিবডি A গ্রুপের লোহিত কণিকাকে জমিয়ে দেয়।
রক্তের গ্রুপ | রক্ত দিতে পারবে | রক্ত নিতে পারবে |
AB+ | AB+ | সবার থেকে |
AB– | AB+, AB– | AB–, A–, B–, 0– |
A+ | A+, AB+ | A+, A–, O+, O– |
A– | A+, A–, AB+, AB– | A–, O– |
B+ | B+, AB+ | B+, B–, O+, O– |
B– | B+, B–, AB+, AB– | B–, O– |
O+ | O+, A+, B+, AB+ | 0+, 0– |
0– | সবাইকে | 0– |
কিন্তু AB গ্রুপের রক্ত অন্য গ্রুপের রক্তকে জমাতে পারে না, কারণ সেখানে কোন অ্যান্টিবডি নেই। ঠিক একই কারণে O গ্রুপের রক্ত নিজের গ্রুপের রক্ত ছাড়া অন্য তিন গ্রুপের রক্তকে জমিয়ে দেয়। অর্থাৎ কারও দেহে 0 গ্রুপের রক্ত থাকলে তিনি কেবল 0 গ্রুপের রক্ত নিতে পারবেন কিন্তু অন্য সব গ্রুপকেই রক্ত দিতে পারবেন।
সার্বজনীন দাতা ও গ্রহীতা
A গ্রুপের দাতা A ও AB রক্ত গ্রহীতাকে রক্ত দিতে পারে। তেমনি B গ্রুপের দাতা B ও AB গ্রুপের গ্রহীতাকে রক্ত দিতে পারে । AB গ্রুপের গ্রহীতাকে A, B, AB ও 0 অর্থাৎ সকল গ্রুপের রক্ত দেখা যায়। এ কারণে AB গ্রুপের রক্তকে সার্বজনীন গ্রহীতা (Universal recipient) বলে।
অন্যদিকে 0 গ্রুপের রক্ত সকল গ্রুপ নিতে পারে, তার জন্য O গ্রুপের রক্তকে সার্বজনীন দাতা Universal donor) বলে।
বম্বে ব্লাড গ্রুপ বা বম্বে ফিনোটাইপ (Bombay Blood Group or Bombay Phenotype)
রক্তের শ্রেণি A, B, AB ও O ছাড়াও আরো একটি শ্রেণি আছে, যার নাম বম্বে ব্লাড গ্রুপ বা বম্বে ফিনোটাইপ। সর্বপ্রথম (১৯৫২) ভারতের বম্বে (মুম্বাই) শহরে এই রক্তশ্রেণির সন্ধান পাওয়া যায় বলে একে বম্বে ব্লাড গ্রুপ বা বম্বে ফিনোটাইপ বলা হয়। এই গ্রুপধারী মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সাধারণত সমগ্র পৃথিবীর মাত্র ০.০০০৪% জনসংখ্যার মানুষ এই গ্রুপধারীর।
সাধারণত যে H অ্যান্টিজেন বা H substance থেকে A ও B উভয় অ্যান্টিজেনই তৈরি হয়, এই বম্বে ব্লাড গ্রুপ-এর ক্ষেত্রে ব্যক্তিটির এই H অ্যান্টিজেনটিই তৈরি হয় না। এক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রক্তের জিনোটাইপ A বা B বা AB রক্তশ্রেণির মতো হলেও কার্যগতভাবে তার রক্তশ্রেণি হয়। মানবদেহের রক্তে H অ্যান্টিজেন বা H substance বর্তমান, যা প্রকৃতপক্ষে A ও B অ্যান্টিজেনের পূর্বসূরী, অর্থাৎ H অ্যান্টিজেনের উপর A ও B অ্যান্টিজেনের উৎপত্তি নির্ভরশীল।
H জিন দ্বারা H অ্যান্টিজেনের সংশ্লেষ নিয়ন্ত্রিত হয়। H জিনের পরিব্যক্তি (mutation) ঘটলে তথা পরিব্যক্ত প্রচ্ছন্ন অ্যালিল (h) দুটি হোমোজাইগাস (hh) অবস্থায় থাকলে H অ্যান্টিজেন সংশ্লেষ ব্যাহত হয়। ফলে A ও B অ্যান্টিজেন উৎপন্ন হয় না এবং জিনোটাইপ L°L° না হওয়া সত্ত্বেও কার্যগত রক্তশ্রেণি হয় O।