প্রজনন (Reproduction)
যে প্রক্রিয়ায় জীব একাকী অযৌন পদ্ধতিতে বা যৌন পদ্ধতিতে অথবা সঙ্গী জীবের সহায়তার যৌন পদ্ধতিতে নিজের মতাে এক বা একাধিক শিশু জীব উৎপন্ন করে বংশবৃদ্ধি করার মাধ্যমে প্রজাতির ধারা বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে তাকে প্রজনন বলে।
হাইড্রার প্রজনন(Reproduction of Hydra)
হাইড্রা অযৌন ও যৌন উভয় পদ্ধতিতে প্রজনন সম্পন্ন করে।
অযৌন প্রজনন (Asexual reproducetion)
জনন কোষ সৃষ্টি না করেই যে প্রক্রিয়ায় জীব প্রজনন সম্পন্ন করে তাকে অযৌন প্রজনন বলে। হাইড্রা মুকুলােদগম বা কোরকোদগম পদ্ধতিতে অযৌন প্রজনন করে।
মুকুল বা কোরক (Bud)
হাইড্রাসহ কোন কোন অমেরুদন্ডী প্রাণীদের দেহে এক ধরনের প্রবৃদ্ধি গঠনের মাধ্যমে অযৌন প্রজনন সম্পন্ন হয়। এই প্রবৃদ্ধিকে মুকুল (Bud) বলে।
মুকুল গঠনের মাধ্যমে এই বিশেষ ধরনের অযৌন প্রজনন প্রক্রিয়াকে মুকুলােদগম (Budding) বা কোরকোদগম বলে।
মুকুলােদগম বর্ণনা (Budding)
এটা হাইড্রার সাধারণ ও স্বাভাবিক অযৌন প্রজনন প্রক্রিয়া।গ্রীষ্মকালে অনুকূল পরিবেশে হাইড্রা একই সাথে এক বা একাধিক মুকুল গঠন করে অযৌন প্রজনন করে। মুকুল গঠন প্রক্রিয়া কয়েকটা ধারাবাহিক ধাপে ঘটে। যথাঃ
- (১) হাইড্রার দেহকান্ডের নীচের দিকে এক্টোডার্মের এক বা একাধিক স্থানের ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ মাইটোসিস পদ্ধতিতে বারবার বিভাজিত হয়। ফলে এ সকল স্থানে কিউটিকলের নীচে একটা করে নিরেট ও স্ফীত প্রবৃদ্ধি বা অংশ গঠিত হয়।
- (২) এই প্রবৃদ্ধিগুলাে কমশঃ আকারে বড় হতে থাকে এবং এর ভিতরে মাতৃ হাইড্রার সিলেন্টেরন প্রসারিত হয়। ফলে প্রবৃদ্ধিটি একটা দ্বিস্তর বিশিষ্ট ফাপা ও নলাকার গঠনরত মুকুলে পরিণত হয়।
- (৩) এই গঠনত মুকুলের অগ্রপ্রান্তে এরপর একে একে হাইপােস্টোম, কর্ষিকা এবং মুখছিদ্র গঠিত হয়।
- ৪) প্রায় একই সাথে গঠনরত মুকুল ও মাতৃহাইড্রার সংযােগস্থলে একটা খাঁজ গঠিত হয় এবং তা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
- (৫) মুখছিদ্র গঠিত হবার পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ দশার মুকুলে খাজটি গভীরতর হতে হতে এক সময় মাতৃ হাইড্রার দেহ থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়।

হাইড্রার যৌন প্রজনন প্রক্রিয়া(Sexual reproduction)
যৌন প্রজনন ও স্ত্রী এবং পুরুষ জননাঙ্গ অর্থাৎ শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয় থেকে যথাক্রমে পুরুষ ও স্ত্রী জনন কোষ অর্থাৎ শুক্রাণু বা ডিম্বাণু সৃষ্টি এবং তাদের নিষেকের মাধ্যমে শিশু জীব উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে যৌন প্রজনন বলে।
হাইড্রা শীতের প্রাক্কালে যৌন প্রজনন পদ্ধতিতে বংশ বৃদ্ধি করে। হাইড্রার স্থায়ী জননাঙ্গ থাকে না।
প্রজনন ঋতুতে প্রথমে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় গঠিত হয়। পরে শুক্রাশয়ে শুক্রাণু এবং ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু গঠিত হয়ে হাইড্রায় যৌন প্রজনন ঘটে। Hydra vulgaris একটা উভয়লিঙ্গিক (Bisexual) প্রাণী।
কিন্তু প্রধানতঃ শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে পৃথক পৃথক সময়ে পরিপক্ক হয় বলে হাইড্রায় স্বনিষেক হয় না, পরনিষেক হয়। হাইড্রার যৌন প্রজনন প্রধান তিনটা ধাপে সম্পন্ন হয়। যথাঃ
(১) গ্যামেটোজেনেসিস, (২) নিষেক ও জাইগােট গঠন, (৩) পরিস্ফুরণ ও শিশু হাইড্রার জন্ম লাভ।
(১) গ্যামেটোজেনেসিস (Gametogenesis)
জনন কোষ বা শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গঠন প্রক্রিয়াকে গ্যামেটোজেনেসিস বলে। গ্যামেটোজেনেসিস দুই ধরনের হয়। যথাঃ (ক) স্পার্মাটোজেনেসিস ও (খ) উত্তজেনেসিস।
ক) স্পার্মাটোজেনেসিস (Spermatogenesis) বা শুক্রাণু গঠন প্রক্রিয়া
স্পার্মাটোজেনেসিস পদ্ধতিতে শুক্লাশয়ে শুক্রাণু (n) বা পুরুষ জনন কোষ গঠিত হয়। (Sperm = শুক্রাণু, gen= গঠন ও sis = পদ্ধতি)স্পার্মাটোজেনেসিসের ধাপসমূহ: স্পার্মাটোজেনেসিস কয়েকটা নির্দিষ্ট ধারাবাহিক ধাপে ঘটে। যথাঃ
(i) এ পদ্ধতিতে প্রথমে দেহকাণ্ডের উপরিভাগে এক বা একাধিক স্থানের ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ মাইটোসিস পদ্ধতিতে বারবার বিভাজিত হয়ে এক বা একাধিক মােচাকৃতিবিশিষ্ট ও নিরেট শুক্রাশয় গঠিত হয়।
(ii) শুক্রাশয়ের কিছু সংখ্যক প্রিমর্ডিয়াল জনন কোষ (2n) বা শুক্রাণু মাতৃকোষ প্রথমে পরপর দুবার মাইটোসিস পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়ে যথাক্রমে গােলাকার স্পার্মাটোগােনিয়া (2n) এবং পরে গােলাকার স্পার্মাটোসাইট (2n) গঠিত হয়।
(ii) এরপর প্রতিটা স্পার্মাটোসাইট (2n) মিয়ােসিস পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়ে ৪টা করে গোলাকার,অপরিণত শুক্রাণু বা স্পার্মাটিডে (n) পরিণত হয়।
(iv) স্পার্মাটিডগুলাে এরপর রূপান্তরিত হয়ে গােলাকার মস্তক, সরু, দেহ ও লেজ বিশিষ্ট হ্যাপ্লয়েড ক্রোমােজোমবিশিষ্ট স্পার্মাটোজোয়ায় (n) বা পরিণত শুক্রাণুতে পরিণত হয়।
শুক্রাণু গঠনের প্রবাহ চিত্র
শুক্রাশয়ের প্রিমর্ডিয়াল জননকোষ বা শুক্রাণু মাতৃকোষ(2n) → মাইটোসিস → স্পারর্মাটোগােনিয়া (2n) → স্পার্মাটোসাইট (2n) → স্পার্মাটিড[অপরিণত শুক্রাণু (n)→ স্পার্মাটোজোয়া বা পরিণত শুক্রাণু (n)
(খ) উওজেনেসিস (Ogenesis) বা ডিম্বাণু গঠন প্রক্রিয়া
(১) এ পদ্ধতিতে ডিম্বাশয়ের প্রি-মর্ডিয়াল জননকোষ বা ডিম্ব মাতৃকোষ (2n) মাইটোসিস পদ্ধতিতে বারবার বিভাজিত হয়ে প্রথমে উওগােনিয়াম (2n) এবং পরে উওসাইটে (2n) পরিণত হয়।
(২) এদের মধ্যে একটা উওসাইট ক্ষণপদ বের করে অন্যান্য উওসাইটগুলােকে খেয়ে ফেলে। ফলে একটা ডিম্বাশয়ে একটামাত্র উওসাইট (2n) থাকে।
(৩) এই উওসাইট এরপর মিয়ােসিস পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়ে একটা সক্রিয় হ্যাপ্লয়েড উওটিড (n) এবং তিনটা নিষ্ক্রিয় পােলার বডি (n) তৈরী হয়।
(৪) এরপর উওটিড রূপান্তরিত হয়ে বড় ও সক্রিয় হয় এবং মাতৃদেহের ডিম্বাশয়ে নিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ডিম্বাশয়ের প্রাচীরটা এসময় ফেটে যায় এবং ডিম্বাণুটি জেলীর মত পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকে।
ডিম্বাণু গঠনের প্রবাহ চিত্র:
ডিম্বাশয়ের প্রিমর্ডিয়াল জনন কোষ বা ডিম্রাণু মাতৃকোষ (2n)>মাইটোসিস>উওগোনিয়াম (2n)→ উওসাইট (2n)>মিয়োসিস→ উওটিড (n) বা অপরিণত>রূপান্তর→ ডিম্বাণু বা ওভাম (n) বা পরিণত ডিম্বাণু।
২। নিষেক (Fertilization) ও জাইগােট গঠন
পরিণত শুক্রাণু বা স্পার্মাটোজোয়া (n) শুক্রাশয়ের নিপলের মাধ্যমে শুক্রাশয় থেকে বের হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতার কেটে একই প্রজাতির অন্য কোন হাইড্রার ডিম্বাশয়ে অপেক্ষমান পরিণত ডিম্বাণু বা ওভামের (n) দিকে যায়।
নিষেক নিশ্চিত করণের জন্য একই জায়গায় একই প্রজাতির একাধিক হাইড্রা দলবদ্ধভাবে বাস করে। এদের মধ্যে একটি মাত্র শুক্রাণুর নিউক্লিয়াস গঠিত মস্তকটি ডিম্বাশয়ের জেলীর মত আবরণী ভেদকরে সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করে নিষেক (n+n) সম্পন্ন করে।
ফলে একটা গােলাকার ডিপ্লয়েড জাইগােট (2n) সৃষ্টি হয়।
৩। পরিস্ফুটন ও শিশু হাইড্রার জন্মলাভ (Development and hatching)
জাইগোট বা নিষিক্ত ডিম্বাণু (2n) এরপর ডিম্বাশয়ে অবস্থান করেই মাইটোসিস বিভাজন পদ্ধতিতে পরিস্ফুটণ শুরু করে। এসময় পরিস্ফুটণশীল ভ্রূণ কয়েকটা পর্যায় ক্রমিক ধাপ পার হয়। যথাঃ
(ক) মরুলা দশা (Morula) : মাইটোসিস পদ্ধতিতে বারবার বিভাজিত হয়ে এককোষী জাইগােট (2n) একটা বহুকোষী, গােলাকার, নিরেট ভ্রূণে পরিণত হয়। একে মরুলা বলে। মরুলার সবগুলাে কোষ (2n)।
(খ) ব্লাসটুলা(Blastula):মরুলার কোষগুলাে এরপর বিচলিত হয়ে বা চারদিকে সরে গিয়ে একটা ফাঁপা একস্তরী বলের মত ভ্রূণীয় দশায় পরিণত হয়। মরুলার ব্লাস্টুলায় পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্লাস্টুলেশন (Blastulation) বলে।
ব্লাস্টুলার গহবরকে ব্লাস্টোসিল (Blastocoel) বলে।
(গ) গ্যাস্ট্রুলা (Gastrula) : ব্লাস্টুলার কোষগুলাে এরপর দ্বিস্তরে সজ্জিত হয়। ফলে ব্লাস্টোসিল বুজে যায়। এভাবে একস্তরী ব্লাস্টুলা দ্বিস্তরী গ্যাস্ট্রুলা দশার ভ্রূণে পরিণত হয়।
এ স্তর দুটোর বাইরের দিকেরটা এক্টোডার্ম (Ectoderm) এবং ভিতরের দিকেরটা এণ্ডোডার্ম (Endoderm)।
পরবর্তীতে এক্টোডার্ম ও এন্ডোডার্মের মধ্যস্থলে অকোষীয়, জেলীর মতাে মেসােগ্লিয়ার গঠন শুরু হয়।
সিস্ট আবরণী গঠন
এর পরপরই ভূণের চারদিকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, কন্টকযুক্ত সিস্ট আবরণী গঠিত হয়।সিস্টে আবৃত ভ্রূণটি এরপর মাতৃদেহ থেকে পৃথক হয়ে পানিতে চলে যায়।
পানিতেই বাঁকি পরিস্ফুটণ সম্পন্ন হয়। এ পর্যায়ে ভ্রূণটা ক্রমে ক্রমে লম্বাকৃতি ধারণ করে এবং ভূণের অগ্রপ্রান্তে ক্রমে ক্রমে হাইপােস্টোম, কর্ষিকা, মুখছিদ্র এবং পিছনের প্রান্তে বৃন্ত ও পদচাকতি গঠিত হয়।
ফলে ভ্রূণটি ক্ষুদ্রাকার শিশু হাইড্রা বা হাইড্রুলায় পরিণত হয়।এরপর হাইড্রুলা সিস্ট আবরণ ভেদ করে পানিতে বের হয়ে আসে এবং স্বাধীন জীবন যাপন শুরু করে।
এই প্রক্রিয়াকে পরিস্ফুটণ বলে। (এক্টোডামের কোষগুলি ক্ষুদ্রতর এবং এন্ডোডর্মের কোষগুলি বৃহত্তর ও লম্বায় এক্টোডার্মের কোষের প্রায় দ্বিগুণ।