হরমোনের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষরণজনিত রোগের নাম, কারণ ও লক্ষণ
রোগের নাম | কারণ | রোগ লক্ষণ |
১। ডোয়ারফিজম | শৈশবকালে STH-এর কম ক্ষরণের ফলে। | বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, উচ্চতা ৩ ফুটের বেশি হয় না। |
২। অ্যাক্রোমিক্রিয়া | প্রাপ্তবয়স্কদের পিটুইটারি ক্ষরণ হ্রাস পেলে। | মুখমণ্ডল, হাত-পা, মেরুদণ্ড ইত্যাদির স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় না। |
৩। জাইগ্যানটিজম | শৈশবকালে STH-এর ক্ষরণ বেশি হলে। | অতিরিক্ত দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় (৭-৮ ফুট)। |
৪। অ্যাক্রোমেগালি বা মারিজ ব্যাধি | প্রাপ্তবয়স্কদের STH-এর ক্ষরণ বেশি হলে। | চোয়াল, হাত-পা, মেরুদণ্ড ইত্যাদির অধিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। |
৫। সাইমন্ড ব্যাধি | পিটুইটারি গ্রন্থির কার্যকারিতা লোপ পেলে। | দেহের ওজন হ্রাস পায়, খিদে কমে যায়, যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়। |
৬। অ্যাডিসন বর্ণিত ব্যাধি | অ্যাড্রিনাল কর্টেক্সের স্বল্পক্ষরণের ফলে। | পেশির দুর্বলতা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, ত্বকের বর্ণের পরিবর্তন ইত্যাদি। |
৭। কুশিং বর্ণিত ব্যাধি | অ্যাড্রিনাল কর্টেক্সের অতি সক্রিয়তার ফলে। | দেহে অতিরিক্ত মেদ সঞ্চিত হয়। বিশেষ করে মুখমণ্ডল গ্রীবা ও নিতম্বদেশে। |
৮। ক্রোটিনিজম | শিশুদের থাইরক্সিন কমে গেলে। | বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটে না। যৌন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। |
৯। মিক্সিডিমা | প্রাপ্তবয়স্কদের থাইরক্সিন ক্ষরণ কমে গেলে। | চোখ-মুখ ফোলা দেখায়, চামড়া পুরু ও খসখসে হয়, জিহ্বা স্কুল, গলার স্বর মোটা হয়ে যায়। |
১০। গয়টার বা গ্রেভস বর্ণিত রোগ | থাইরক্সিন ক্ষরণ বেড়ে গেলে। | গলগণ্ড বা থাইরয়েড বৃদ্ধি পায়, চক্ষু বিস্ফোরিত হয়। |
১১। টিটেনি | প্যারাথরমোন ক্ষরণ কমে গেলে। | পেশির খিঁচুনি, তড়কা ইত্যাদি। |
১২। ডায়াবেটিস মেলিটাস | ইনসুলিনের কম ক্ষরণের ফলে। | রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, মূত্রের সঙ্গে শর্করা নির্গত হওয়া ইত্যাদি। |
১৩। ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস | ADH নিঃসরণ কমে গেলে। | বেশি পরিমাণে এবং ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ, প্রবল তৃষ্ণা ইত্যাদি। |
হরমোনের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষরণের প্রভাবজনিত রোগের বর্ণনা
বামনত্ব (Dwarfism)
শৈশবে অগ্র পিটুইটারি গ্রন্থির স্বল্প ক্ষরণে (STH-এর ক্ষরণ হ্রাস পাওয়ায়) সামগ্রিকভাবে দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং বৃদ্ধিজনিত একটি রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তাকে বামনত্ব বলে। সাধারণভাবে দেহের বিভিন্ন অংশের বৃদ্ধি সঠিক অনুপাতে হলেও বৃদ্ধির হার মারাত্মকভাবে কমে যায়।
যেমন- ১০ বছরের একটি শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ৪ থেকে ৫ বছরের স্বাভাবিক শিশুর সমতুল্য হয়। একই শিশুর ২০ বছর বয়সে যে বৃদ্ধি হয় তা স্বাভাবিক ৭ থেকে ১০ বছরের শিশুর সমতুল্য হয়। বৃদ্ধি হরমোনের স্বল্পতাই এই বৃদ্ধি হ্রাসের মূল কারণ। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হ্রাসজনিত অবস্থাকে বামনত্ব বলে।
অতিকায়ত্ব (Gigantism)
পিটুইটারি গ্রন্থির অগ্রখণ্ডের বৃদ্ধি হরমোন (STH) নিঃসরণকারী কোষগ্রন্থিগুলোর সক্রিয়তা বেড়ে যায়, ফলে অতিরিক্ত বৃদ্ধি হরমোন ক্ষরিত হয়। এই অবস্থা যদি বয়ঃসন্ধিকালের পূর্বে হয় তবে দৈহিক বৃদ্ধি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উচ্চতা ৮ ফুট পর্যন্ত হয়। এই অবস্থাকে অতিকায়ত্ব বা দৈত্যত্ব বলে।
অতিকায় ব্যাক্তির রক্তের শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অগ্নাশয়ের আইলেটস অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্স এর বিটা কোষ গ্রন্থিগুলোর অধিক ইনসুলিন ক্ষরণজনিত কারণে বিনষ্ট হয়। এরফলে ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগ হয়।
গরিলাত্ব (Acromegaly)
প্রাপ্ত বয়স্কদের পিটুইটারি গ্রন্থির বেশি হলে চোয়াল, হাত-পা, মেরুদণ্ড ইত্যাদির
অধিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয় অর্থাৎ অস্থিগুলো প্রস্থে বেড়ে যায় কিন্তু দৈর্ঘ্যে বাড়ে না, এ অবস্থাকে গরিলাতু বা অ্যাক্রোমেগালি বলে। এ রোগের ফলে হাত ও পায়ের অস্থিগুলোর স্কুলতা বাড়ে এবং হাতের আঙুলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য হাতের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়।
পায়ের আকার এমন বেড়ে যায় যে, অনেক বড় সাইজের জুতা পরতে হয়। নিচের চোয়াল সামনের দিকে বেড়ে যায়। করোটি, নাক, মাথার অগ্রভাগ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাকের আকার দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সর্বশেষ অবস্থায় অনেক কোমল কলা, অঙ্গ যেমন- জিহবা, যকৃৎ এবং বৃক্ক মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়।
কুশিং সিনড্রোম (Cushing syndrome)
অ্যাড্রিনাল কর্টেক্সের অতি সক্রিয়তার ফলে দেহে বিশেষ করে মুখমণ্ডল, গ্রীবা ও নিতম্বদেশে অতিরিক্ত মেদ সঞ্চিত হয়, এ অবস্থাকে কুশিং সিনড্রোম বলে। এই রোগের ফলে পেশি ক্ষীণ ও শিথিল হয়। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষীণ ও শিথিল হয়। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং মূত্রে গ্লুকোজ রেচন ঘটে। এ রোগ হলে উদর ঝোলানো হয় এবং ঘা সারতে দেরি হয়।
মিক্সিডিমা (Myxedema)
প্রাপ্তবয়স্ক লোকের থাইরয়েড গ্রন্থির স্বল্প সক্রিয়তার জন্য যে অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা যায় তাকে মিক্সিডিমা বলে। এ রোগে অবসাদ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব দেখা যায়। দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা ঘুম হয়। চুলের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ত্বক খসখসে হয়। গলার স্বর ব্যাঙের মতো কর্কশ হয়। মুখমণ্ডল ফুলে যায়।
গয়টার বা গ্রেভ বর্ণিত রোগ
থাইরয়েড গ্রন্থির অতি সক্রিয়তার ফলে স্ফীত নেত্রসহ যে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে গ্রেভ বর্ণিত রোগ বলে। থাইরক্সিন হরমোনের অতিক্ষরণের ফলে এ রোগ হয়। এ রোগ হলে ছানাবড়া চক্ষু, থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি, দেহের দ্রুত ক্ষয় অর্থাৎ ওজন কমে যায়। উত্তেজনা, অনিদ্রা, রুক্ষ ও খিটখিটে মেজাজ হয় এবং আবেগপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
টিটেনি (Tetany)
প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির স্বল্প সক্রিয়তার ফলে ক্যালসিয়াম (Ca²+), সোডিয়াম (Na+) এবং পটাশিয়াম (K+) আয়ন গ্রন্থিগুলোর স্থিতাবস্থা নষ্ট হয়ে যে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে ঐচ্ছিক পেশির খিচুনি পরিলক্ষিত হয় তাকে টিটেনি বলে। টিটেনি বা ধনুষ্টংকার রোগে মুখমণ্ডলের পেশির দ্রুত সংকোচন ঘটে। হাতের কবজি ও বুড়ো আঙুল বেঁকে যায় এবং আঙুলের বিক্ষেপ ঘটে।
ক্রেটিনিজম
ভ্রূণাবস্থায়, কৈশরে কিংবা শৈশবে থাইরয়েদ গ্রন্থির চূড়ান্ত স্বল্প ক্রিয়ায় এ রোগ হয়। এ অবস্থাকে দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। ক্রেটিনিজম রোগটি জন্মগত থাইরয়েড গ্রন্থির অনুপস্থিতি অথবা থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন ক্ষরণে ব্যর্থতার কারণে হয়ে থাকে। শিশু স্থূলাকৃতি,খর্বাকৃতি, ও বলিষ্ট হয়। উদর অঞ্চল বেশি স্ফীত হয়। অন্তঃকংকাল বৃদ্ধির তুলনায় জিহবা এত লম্বা হয় যে, গলাধঃকরণ ও শ্বাসক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে। মুখ থেকে অনবরত লালা নিঃসরণ ও পেট বড় হয়ে যায়। এতে শিশুর দাঁত ওঠা, কথা বলা, দাঁড়ানো সবই বিলম্বিত হয়। মানসিক বিকাশ সঠিক না হওয়ায় শিশু জড়বুদ্ধিসম্পন্ন এবং মখমণ্ডলে বোকা ভাব লক্ষ করা যায়।