মানবদেহে হরমােনের প্রভাব (Effect of hormone)
মানুষের বৃদ্ধি হরমােন (Human Growth Hormone, HGH) সাধারণভাবে সােমাটোট্রপিন (Somatotrophin) নামে পরিচিত। এটি এক ধরনের পেপটাইড হরমােন যা প্রায় ২০০ টি অ্যামিনাে এসিডে গঠিত। মানবদেহের বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত এ হরমােন শরীরে স্বাভাবিকভাবেই উৎপন্ন হয়।
মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থিতে এটি উৎপন্ন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩০ বছর বয়সের পরে বৃদ্ধি হরমােনের ক্ষরণ কমে যায়।পরবর্তী প্রতি ১০ বছরে ক্ষরণ প্রায় ১৪% হারে হ্রাস পায়। বৃদ্ধি হরমােন যত কমবে, শরীরে ততই বয়সের ছাপ বাড়বে। এ সময় দেহে বৃদ্ধি হরমােন প্রয়ােগ করলে বয়সের ছাপ মিলিয়ে যাবে কিংবা ছাপ পড়ার গতি কমে যাবে।
অর্থাৎ বলিরেখার আবির্ভাব, চর্বিহীন পেশি ও হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, কার্যহীনতা, ওজন বেড়ে যাওয়া প্রভৃতির গতি কমে যাবে। শুধু এ কারণেই নয় অনেক রােগ ব্যাধি ও শারীরিক জটিলতা রােধে শিশু বৃদ্ধ সবার ক্ষেত্রে বৃদ্ধি হরমােন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যাদের শরীরে পরিমিত বৃদ্ধি হরমােন উৎপন্ন হয় না সেক্ষেত্রে সঠিক পরিমাণ নিশ্চিত করতে ইনজেকশন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রয়ােগ করা হয়। কিন্তু অতি প্রয়ােগে মারাত্মক ক্ষতির আশংকা দেখা দিতে পারে। নিচে বৃদ্ধি হরমােনের ইতিবাচক ক্রিয়া ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করা হলাে।
মানবদেহে বৃদ্ধি হরমােনের ইতিবাচক ক্রিয়া
বৃদ্ধি হরমােনের পরিমিত ক্ষরণ দেহ বৃদ্ধির জন্য উপকারি। নিচে মানবদেহে বৃদ্ধি হরমােনের ইতিবাচক ক্রিয়ার উল্লেখ করা হলাে-অতিরিক্ত চর্বি ও গুকোজ পুড়িয়ে দেহকে রাখে প্রাণবন্ত ও সক্রিয়। পেটের চর্বি কমিয়ে কার্ডিওভাস্কুলার রােগ প্রতিরােধে সাহায্য করে। হাড়ের ঘনত্ব বাড়িয়ে তা শক্তিশালী করে তােলে, ফলে সহজে হাড় ভেঙ্গে যায় না। হাড় সুস্থ থাকলে লিগামেন্ট ও টেন্ডন সুস্থ সবল থাকে ।
পর্যাপ্ত বৃদ্ধি হরমােন ক্ষরণে ঘুম নির্বিঘ্ন হয়, নিদ্রাহীনতা দূর হয়। ফুসফুসের কাজে উৎকর্ষ সাধন ঘটে ফলে প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আগুন বা অন্যান্য কারণে সৃষ্ট দ্রুত ক্ষতিপূরণ করতে হরমােন সাহায্য করে। কোন শিশুর স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য কম হলে (লম্বা হতে পারছে না কিংবা বামনত্বে ভুগছে এমন) তার সমাধানে বৃদ্ধি হরমােন প্রয়ােগে সুফলদায়ক হতে পারে।
ক্যান্সার নিরাময়ে বা মস্তিষ্ক সার্জারির পর বিকিরণ (Radiation) প্রয়ােগে বৃদ্ধি হরমােন উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় বলে কৃত্রিম বৃদ্ধি হরমােন ব্যবহারে ভুক্তভােগীরা উপকৃত হন। HIV/AIDS আক্রান্ত রােগীদের পেশি ক্ষয় পূরণে কৃত্রিম বৃদ্ধি হরমােন ভালাে কাজ দেয়।
প্রতি সপ্তাহে কয়েকবার স্বল্পমাত্রার বৃদ্ধি হরমােনের ডােজ নিলে টারনার সিন্ড্রোম (Turner Syndrome) এ আক্রান্তদের হৃদস্পন্দন, উদ্যম ও ব্যায়াম করার ক্ষমতার উন্নতি ঘটায় । প্রাডের-উইলি সিন্ড্রোম (Prader-Willi syndrome) এ আক্রান্ত শিশু বা পূর্ণবয়স্কদের বিপাক সংক্রান্ত অসুবিধা দূরীকরণে সাহায্য করে।
শারীরবৃত্তীয় কাজে হরমোনের প্রভাব
- ১. পৌষ্টিকনালির অন্তঃক্ষরা কোষ থেকে নিঃসৃত গ্যাস্ট্রিন, সিক্রেটিন ও কোলেসিস্টোকিনিন হরমোন পরিপাক ক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট এনজাইমগুলোর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
- ২. থাইরক্সিন, ইনসুলিন, গ্লুকাগন, গ্লুকোকটিকয়েড হরমোন শর্করা বিপাক করে।
- ৩. থাইরক্সিন হরমোন প্রোটিন, স্নেহদ্রব্য ও খনিজ আয়ন বিপাক এবং টেস্টোস্টেরণ ও ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রোটিন বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে।
- ৪. এপিনেফ্রিন, নরএপিনেফ্রিন, অ্যাড্রেনালিন হরমোন হৃৎক্রিয়া ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করে।
- ৫. অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে ক্ষরিত অ্যালডোস্টেরণ Na+, K+ আয়নের সমতা রক্ষা করে।
- ৬. স্টেরয়েডধর্মী হরমোনগুলো প্রোটিন সংশ্লেষণে, গ্রোথ হরমোন ফ্যাটকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদনে প্রভাবিত করে।
- ৭. ADH হরমোন পানি শোষণ ও পানি সাম্য বজায় রাখে। বৃক্ক থেকে ক্ষরিত এরিথ্রোপোয়েটিন হরমোন লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
- ৮. ইস্ট্রোজেন ঋতুচক্র ও স্তনগ্রন্থির বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে, প্রোজেস্টেরণ জরায়ুর প্রাচীরে নিষিক্ত ডিম্বাণু স্থাপন এবং গর্ভাবস্থায় স্তনগ্রন্থির বিকাশ ঘটায়, টেস্টোস্টেরণ শুক্রাণুজনন (spermatogenesis)-এ শুক্রাশয়কে উদ্বুদ্ধ করে।
- ৯. প্রসবের সময় রিলাক্সিন শ্রোণীদেশীয় লিগামেন্ট ও পেশির প্রসারণ ঘটিয়ে এবং অক্সিটোসিন জরায়ুর সঙ্কোচন ঘটিয়ে প্রসব ত্বরান্বিত করে।
- ১০. টেস্টোস্টেরণ, এস্ট্রোজেন ও গোনাডোকটিকয়েড হরমোন গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।
- ১১. গ্রোথ হরমোন, থাইরক্সিন, এস্ট্রোজেন, প্রোল্যাকটিন সন্তান প্রসবকারী মায়ের স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি ও দুধ উৎপাদন
মানবদেহে বৃদ্ধি হরমােনের নেতিবাচক ক্রিয়া বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
মানবদেহে বৃদ্ধি হরমােনের নেতিবাচক ক্রিয়া রয়েছে। বৃদ্ধি হরমােনের পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে গেলে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন-
অ্যাক্রোমেগালি (Acromegaly) / মারিজ ব্যাধি, হাইপােগ্লাইসিমিয়া (Hypoglycemia), হৃদপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া,কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া (অর্থাৎ হৃদ সংবহনতন্ত্রে জটিলতা), পেশি ফুলে যাওয়ায় সন্ধি ব্যথা,কার্পাল টানেল সিনড্রোম (carpal tunnel syndrome), ত্বকের অসাড়তা ও কাঁটা কাঁটা ভাব, ডায়াবেটিকস এর ঝুঁকি বেড়ে যায়, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী টিউমার বৃদ্ধি পায়, চুল / রােমের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটে এবং যকৃতের ক্ষতি হয়।
অ্যাক্রোমেগালি / মারিজ ব্যাধি
পূর্ণবয়স্ক মানবদেহে অতিরিক্ত বৃদ্ধি হরমােনের ফলে মুখমণ্ডল, মাথা, হাত, পা ও বুকের অস্বাভাবিক স্ফীতি।
টার্নার সিনড্রোম
নারী দেহে ক্রোমােসোম সংক্রান্ত ব্যাধি যখন দুটি X ক্রোমােযােম এর একটি কিংবা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
প্রাডের-উইলি সিনড্রোম
মানবদেহে ক্রোমােজোম ১৫ এ ক্রোমােসােমীয় পদার্থের অনুপস্থিতির সৃষ্ট ব্যাধি। এ রােগের লক্ষণ হচ্ছে বিলম্বিত বৃদ্ধি, দুর্বল পেশি গঠন, খর্ব আকৃতি, ছােট হাত পা, অসম্পূর্ণ যৌন পরিস্ফুটন, বিশেষ ধরনের মুখমণ্ডল, সারাক্ষণ ক্ষুধাভাব ইত্যাদি।
হাইপােগ্লাইসিমিয়া
রক্তে অস্বাভাবিক কম মাত্রায় গ্লুকোজের উপস্থিতি।
কার্পাল টানেল সিনড্রোম
হাতের তালুতে সরবরাহকারী মিডিয়ান স্নায়ু কজির গােড়ায় চাপা পড়লে আঙুল ও হাতে, এমন কি কনুই পর্যন্ত অসাড় ও কাঁটা কাঁটা ভাব।