অ্যান্টিবডি (Antibody) কী?
দেহে অনুপ্রবেশকৃত এন্টিজেনের বিরুদ্ধে রক্তরসে অথবা কলারসে প্রতিরক্ষামূলক যে জৈবরাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয় তাকে অ্যান্টিবডি বলে।
অ্যান্টিবডির বৈশিষ্ট্য
- অ্যান্টিবডি অ্যান্টিজেনের বিপরীত বস্তু বা নিজস্ব বস্তু বা কণিকা বা কোষ অথবা কোষগুচ্ছ ।
- অ্যান্টিবডি প্রধানত অ্যান্টিজেনের সাড়ায় দেহের B-লিম্ফোসাইট থেকে উৎপাদিত প্রােটিন জাতীয় পদার্থ। এরা রক্তের প্লাজমা ও কলারসে বর্তমান থাকে।
- এরা অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত (combine) হতে পারে এবং ক্লোনাল নির্বাচন (colonal selection) দ্বারা উৎপাদিত হয় এবং দেহের প্রধান সৈনিক বা রক্ষণাবেক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
- অ্যান্টিবডিগুলাে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত অ্যান্টিজেনকে ভক্ষণ করে, কখনাে বিনষ্ট করে, কখনাে মেরে ফেলে, কখনাে বাইরে নিক্ষেপ করে।
- অ্যান্টিজেন হচ্ছে non-self আর অ্যান্টিবডি হচ্ছে self বস্তু। দেহের সব অ্যান্টিবডি গামা-গ্লোবিউলিন (y-globulin) নামে পরিচিত।
- অ্যান্টিবডিসমূহ দেহের সুরক্ষার(immunity) কাজ করে তাই এদেরকে ইমিউনােগ্লোবিউলিন (Immunoglobulin, সংক্ষেপে-Ig) বলা হয়।
- অ্যান্টিবডির আণবিক ওজন ১,৫০,০০০-৯,০০,০০০/- ডাল্টনের মধ্যে সীমিত। প্লাজমা প্রােটিনের প্রায় ২০% ইমিউনােগ্লোবিউলিন।

অ্যান্টিবডি বা ইমিউনােগ্লোবিউলিনের গঠন
সকল প্রকার অ্যান্টিবডির একটি সাধারণ গঠন লক্ষ করা যায়। গাঠনিক অংশগুলাে নিম্নরূপ-
১। হালকা চেইন ও ভারী চেইন
প্রতিটি অ্যান্টিবডি প্রধানত চারটি পলিপেপটাইড চেইন দ্বারা গঠিত। এদের মধ্যে দুটো দৈর্ঘ্যে ছােট (যাদের প্রতিটিতে প্রায় ২০০-২২০টি অ্যামিনাে এসিড থাকে) ও অপর দুটি আকারে বড় (যাদের প্রতিটিতে প্রায় ৪০০-৪৫০টি অ্যামিনাে এসিড থাকে)।
ছােট পলিপেপটাইড চেইন দুটিকে হালকা চেইন ও বড় পলিপেপটাইড চেইন দুটিকে ভারী চেইন নামে অভিহিত করা হয়। হালকা ও ভারী চেইনের ওজন যথাক্রমে 23KD ও 50-70 KD (KD= KiloDaltons)।কোনাে কোনাে অ্যান্টিবডির চারটির বেশি পলিপেপটাইড শৃঙ্খলও থাকতে পারে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারী চেইনের প্রান্তে একটি হালকা চেইন সমান্তরালভাবে অবস্থান করে এবং এভাবে প্রান্তদেশে অন্তত দুইটি হালকা ও ভারী উভয় ধরনের জোড়া তৈরি হয়।
২। ডাইসালফাইড বন্ধন (Disulfide bond)
পলিপেপটাইড চেইন শৃঙ্খলগুলাে পরস্পরের সাথে ডাইসালফাইড বন্ধন (s-s) দ্বারা যুক্ত হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে Y-আকৃতির অ্যান্টিবডি গঠন সৃষ্টি করে। কখনাে কখনাে এই আকৃতি T-এর মতােও দেখা যায়।
৩। স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল অংশ (Constant and variable region)
প্রতিটি ভারী চেইন ও হালকা চেইনের দুটি অংশ থাকে- একটি অপরিবর্তনশীল অংশ বা স্থায়ী অংশ এবং অপরটি পরিবর্তনশীল অংশ। পরিবর্তনশীল অংশ প্রতিটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির ক্ষেত্রে আলাদা হয় এবং এই অংশেই অ্যান্টিজেনের সঙ্গে অ্যান্টিবডির সংযুক্তি ঘটে।
অ্যান্টিজেনের এ অংশটির নাম প্যারাটপ (paratope)। এটি তালা-চাবি ( lock and key) পদ্ধতিতে কাজ করে। এক্ষেত্রে চাবি হচ্ছে প্যারাটপ, আর তালা অ্যান্টিজেন (জীবাণু)। যেহেতু অধিকাংশ অ্যান্টিবডির অ্যান্টিজেনকে আবদ্ধ করার জন্য দুটি পরিবর্তনশীল অংশ আছে তাই এদের বাইভ্যালেন্ট(bivalent) বলে।
অ্যান্টিবডির প্রকারভেদঃ (Types of Antibody)
মানবদেহের রক্তে পাঁচ রকমের ইমিউনােগ্লোবিউলিন অর্থাৎ অ্যান্টিবডি দেখা যায়। যথা- IgG, IgA, IgM, IgD ও IgE । এগুলাে মানবদেহের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাঁচ প্রকার অ্যান্টিবডির মধ্যে IgG রক্তরসে সর্বাধিক মাত্রায় থাকে এবং IgD ও IgE সবচেয়ে কম পরিমাণে থাকে। এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ-
IgG বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-G
এ ধরনের অ্যান্টিবডি রক্তেই বেশি থাকে, তবে লসিকা ও অন্ত্রেও পাওয়া যায়। মানুষের রক্তের সব ধরনের অ্যান্টিবডির প্রায় ৮০% IgG। এরা মনােমার হিসেবে থাকে। এর চারটি প্রকারভেদ আছে। যথা- IgG1, IgG2, IgG3; ও IgG4 । এরা সহজেই অমরাকে (placenta) অতিক্রম করতে পারে, ফলে মায়ের রক্ত থেকে ভ্রূণের রক্তে স্থানান্তরিত হয়। এই কারণে একে ম্যাটারনাল অ্যান্টিবডিও (maternal antibody) বলে।
IgG বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-G এর কাজ
ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসকে অপসােনাইজেশন (opsonisation) এর মাধ্যমে ধ্বংস করে। এগুলাে বিষাক্ত পদার্থ (toxin) প্রশমনেও কাজ করে এবং কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমকে (complement system) উদ্দীপিত করে দেহকে সুরক্ষিত
IgM বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-M
এরা সবচেয়ে বড় আকারের অ্যান্টিবডি এবং জ্বণের দেহে প্রথম সংশ্লেষিত হয়। রক্তে এরা পেন্টামার হিসেবে থাকে। এছাড়া এরা লসিকা এবং B-লিম্ফোসাইটের উপরিতলে অবস্থান করে। রক্তরসে এদের পরিমাণ প্রায় ৫-১০%। এর ২টি প্রকারভেদ আছে। যেমন- IgM1 ও IgM2।
IgM বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-M এর কাজ
এ ধরনের অ্যান্টিবডি অ্যাগুটিনেশন, ব্যাকটেরিওলাইসিস (bacteriolysis), কমপ্লিমেন্ট ফিক্সেশন (complement fixation) প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের প্রতিরক্ষায় সাহায্য করে। এমনকি এরা ফ্যাগােসাইটোসিস ত্বরান্বিত করে এবং সব ধরনের অ্যান্টিবডির তুলনায় পরজীবী দমনে এরা অধিক কার্যকরী। অণুজীবের পলিস্যাকারাইড জাতীয় অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে বিশেষ কার্যকরী। রক্তে ABO গ্রুপের অ্যান্টি-A ও অ্যান্টি- B এবং জীবাণু প্রতিরােধে সংশ্লেষিত অ্যান্টিবডি IgM।
IgA বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-A
এ ধরনের অ্যান্টিবডি রক্তে বেশি থাকে। এছাড়া ঘাম, অশ্রু, লালা ইত্যাদিতেও এদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এরা মনােমার ও ডাইমার হিসেবে থাকে। অ্যান্টিবডির প্রায় ১০-১৫% এই প্রকার। মিউকাস স্তরে এর ক্ষরণ ঘটে। সব ক্ষরিত দেহ তরলে এটি থাকে। তাই একে ক্ষরণকারী অ্যান্টিবডি (secretory antibdoy) বলে। এর ২টি প্রকারভেদ আছে। যেমন- IgA1 ও IgG1। মায়েদের কলােস্ট্রামেও IgA পাওয়া যায়।
IgA বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-A এর কাজ
মিউকাস স্তরে ক্ষরিত IgA দেহের অনাবৃত তলকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং জীবাণুকে পােষক দেহে প্রবেশে বাধা দেয়।
IgD বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-D
রক্তে এ জাতীয় অ্যান্টিবডি খুব কম পরিমাণে (০.২%) থাকে। এরা মনােমার হিসেব B-লিম্ফোসাইটের উপরিতলে সংলগ্ন থাকে।
IgD বা ইমিউনােগ্লোবিউলিন-D এর কাজ
এরা B-লিম্ফোসাইটের অ্যান্টিজেন গ্রাহক হিসেবে কাজ করে এবং B-লিম্ফোসাইটকে উত্তেজিত করে অ্যান্টিবডি ক্ষরণে প্ররােচিত করে।
IgE ইমিউনােগ্লোবিউলিন-E
রক্তরসে বেশ অল্প পরিমাণে (০.১%) থাকে। এরা মনােমার অবস্থায় মাস্ট কোষ ও বেসােফিল শ্বেতকণিকার পদার ওপর সংলগ্ন থাকে।
IgE এর কাজ
কৃমিজাতীয় পরজীবী নিষ্কাশনে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি থেকে দেহকে রক্ষা করে।
অ্যান্টিবডির কার্যপদ্ধতি
অ্যান্টিবডির প্রতিরক্ষা অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। একটি অ্যান্টিবডি একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন বা নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেই শুধুমাত্র কাজ করে থাকে। অ্যান্টিবডি নিম্নলিখিত যেকোনাে একটি পদ্ধতির সাহায্যে অনুপ্রবেশকারী জীবাণু বা তার প্রতিবিষকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে-
১। দলবদ্ধকরণ বা পীভবন (Agglutination)
এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি একাধিক অ্যান্টিজেনসম্পন্ন জীবাণুর অ্যান্টিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে তাদের দলবদ্ধ করে। এই প্রক্রিয়াকে অ্যাটিনেশন বলে। যে অ্যান্টিবডি অ্যান্টিজেন যুক্ত কোষগুলােকে দানা বাঁধতে সাহায্য করে তাদের অ্যাগুটিনিন (agglutinin) বলে ।
২। অধঃক্ষেপণ (Precipitation)
এক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির বিক্রিয়ালদ্ধ পদার্থ অধঃক্ষিপ্ত হয়। যে অ্যান্টিবডি অ্যান্টিজেনকে অধঃক্ষিপ্ত করে, তাকে প্রেসিপিটিন (precipitine) বলে।
৩। অপসােনাইজেশন (Opsonization)
অ্যাগুটিনেশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি অণুজীবগুলাের ফ্যাগােসাইটোসিসকে আরাে ত্বরান্বিত করে। ফ্যাগােসাইটোসিসের জন্য অণুজীবগুলােকে অ্যান্টিবডি যেভাবে সমর্থ বা যােগ্য করে তােলে তাকে অপসােনাইজেশন বলে। এর অ্যান্টিবডিকে অপসােনিন (Opsonin) বলে।
৪। বিশ্লিষ্টকরণ (Lysis)
এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি সরাসরি জীবাণুর ঝিল্লিকে আক্রমণ করে এবং তাকে ছিন্ন করে ফেলে।
৫। ব্যাকটেরিওলাইসিন (Bacteriolysin)
এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি দেহে প্রবেশকারী জীবাণুর কোষকে ধ্বংস করে।
সংক্ষেপে অ্যান্টিবডির প্রধান কাজ
- দেহে অনুপ্রবেশকৃত ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান নষ্ট করতে সহায়তা করে ।
- ব্যাকটেরিয়া নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থকে নিষ্ক্রিয় করতে সহায়তা করে ।
- গর্ভকালীন সময়ে অ্যান্টিবডি মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করে বাচ্চার দেহের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- কিছু কিছু অ্যান্টিবডি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- কিছু অ্যান্টিবডি দেহে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের অনুপ্রবেশে বাধা দান করে ।
- অনেক অ্যান্টিবডি আছে যেগুলাে কৃমি ধ্বংস করতে সহায়তা করে।
- অপসােনাইজেশনের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে; এরা কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমকে সক্রিয় করে।
মনােক্লোনাল অ্যান্টিবডি কী ?
যে সব অ্যান্টিবডি এক প্রকার প্লাজমা কোষ থেকে উৎপন্ন হয়,তাদের মনােক্লোনাল অ্যান্টিবডি বলে।
পলিক্লোনাল অ্যান্টিবডি ?
যে সব অ্যান্টিবডি বহু প্রকার প্লাজমা কোষ থেকে উৎপন্ন হয় তাদের পলিক্ৰোনাল অ্যান্টিবডি