রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন

রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন

জীবনধারণের জন্য শ্বসন অপরিহার্য। জীবের শ্বসনের জন্য অক্সিজেন (O₂) প্রয়োজন হয়। ০₂ এর উপস্থিতিতে কোষ মধ্যস্থ খাদ্যবস্তু জারিত হয়। আর কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO₂) হলো শ্বসনজাত বর্জ্য। পরিবেশ থেকে জীব O₂ গ্রহণ করে এবং উৎপন্ন CO₂ পরিবেশে ত্যাগ করে। একে গ্যাস বিনিময় বলে। গ্যাস পরিবহনে রক্তের শ্বাসরঞ্জকের (যেমন- হিমোগ্লোবিন) ভূমিকাই মুখ্য। এটি একটি অন্তঃশ্বসন প্রক্রিয়া। মানুষের দেহের মধ্যে ০₂ এবং CO₂ পরিবহন কৌশল আলোচনা করা হলো।

রক্তের মাধ্যমে O₂ পরিবহন (Transportation of O₂ by blood)

কোষীয় শ্বসনে জারণ কার্যসম্পাদনের জন্য কোষে প্রচুর পরিমাণ O₂ এর প্রয়োজন হয়। এই O₂ ফুসফুস কর্তৃক বায়ুমণ্ডলে গৃহীত হয় এবং রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়ে দেহকোষে পৌঁছায়। রক্ত কর্তৃক O₂ দুই ভাবে পরিবাহিত হয়।

(১) ভৌত দ্রবণ রূপে O₂ পরিবহন

প্রায় ২% O₂ রক্তের প্লাজমায় দ্রবীভূত হয়ে ভৌত দ্রবণ রূপে পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে ০.২ মিলিলিটার O₂ ভৌত দ্রবণ রূপে পরিবাহিত হয়। দ্রবীভূত অংশই রক্তে ১০০ মিলিমিটার পারদ চাপ সৃষ্টির জন্য দায়ী।

(২) রাসায়নিক যৌগ রূপে O₂ পরিবহন

প্রায় ৯৮% O₂ রাসায়নিক যৌগ রূপে রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়। ফুসফুসের অ্যালভিওলাই থেকে ব্যাপনের মাধ্যমে O₂ কৈশিক জালিকার রক্তে প্রবেশ করে। O₂ রক্তে প্রবেশের পর লোহিত কণিকায় অবস্থিত হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অস্থায়ী যৌগ অক্সিহিমোগ্লোবিন (oxyhaemoglobin) গঠন করে। রক্তের pH মান বেশি থাকলে অক্সিজেনের প্রতি হিমোগ্লোবিনের আকর্ষণ বেশি থাকে।

রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পরিবহন।

হিমোগ্রোবিন O₂ পরিবহন করে বলে একে শ্বাসরঞ্জক বলে।হিমোগ্রোবিন হিম নামক আয়রন রঞ্জক এবং গ্লোবিন নামক প্রোটিন নিয়ে গঠিত। উল্লেখ্য যে, হিমোগ্লোবিনকে Hb আকারে প্রকাশ করা হয় এবং প্রতি অনু হিমোগ্রোবিন ৪ অণু অক্সিজেন যুক্ত করতে পারে। O₂ এর সাথে হিমোগ্লোবিনের রাসায়নিক বিক্রিয়া উভমুখী।

রক্তের মাধ্যমে CO₂ পরিবহন (Transportation of CO₂ by blood)

শর্করা জারণের সময় কোষে CO₂ সৃষ্টি হয়। এই CO₂ দেহের জন্য ক্ষতিকর। কোষ থেকে CO₂ রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়ে ফুসফুসে পৌঁছায় এবং ফুসফুস থেকে বায়ুতে মুক্ত হয়। রক্তে সাধারণত ২৩-২৯ mEq (milliequivalents per liter) CO₂ থাকে। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে CO₂ রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়।

ভৌত দ্রবণ বা কার্বনিক এসিডরূপে কার্বনডাইঅক্সাইড পরিবহন

কিছু CO₂ (৫%) রক্তের প্লাজমার বা রক্তরসের H₂O এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড উৎপন্ন করে। এই কার্বনিক এসিড বিশেষ কোনো পরিবর্তন ছাড়াই প্লাজমার মাধ্যমে ফুসফুসে পরিবাহিত হয়।

ভৌত দ্রবণ  বা কার্বনিক এসিডরূপে কার্বনডাইঅক্সাইড পরিবহন।

কার্বামিনো হিমোগ্লোবিন যৌগ রূপে CO2 পরিবহন

রক্তের প্লাজমায় আগত CO₂ এর কিছু অংশ (১০%) লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। লোহিত কণিকার মধ্যে যে হিমোগ্লোবিন থাকে তার প্রোটিন (গ্লোবিন) অংশের অ্যামিনো গ্রুপের (-NH₂) সঙ্গে CO₂ বিক্রিয়া করে কার্বামিনো হিমোগ্লোবিন যৌগ গঠন করে ও ফুসফুসে আসার পর CO₂ মুক্ত করে। প্লাজমা বা রক্তরসে অবস্থিত CO₂ এর একাংশ প্রোটিন শ্রেণিভুক্ত অ্যামিনো গ্রুপের (PrNH₂) সঙ্গে যুক্ত হয়ে কার্বামিনোপ্রোটিন গঠন করে পরিবাহিত হয়।

কার্বামিনো হিমোগ্লোবিন যৌগরূপে কার্বনডাই অক্সাইড পরিবহণ।

(৩) বাই-কার্বনেট যৌগ রূপে

৮৫% CO2 বাই-কার্বনেট যৌগ রূপে রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়। CO₂ ব্যাপন প্রক্রিয়ায় লোহিত রক্তকণিকায় প্রবেশ করে কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ নামক এনজাইমের উপস্থিতিতে সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বানিক এসিড H2CO3 সৃষ্টি করে। এই কার্বনিক এসিডের অধিকাংশ ভেঙে H+ HCO3 আয়নে পরিণত হয়।

বাইকার্বোনেট আয়নরূপে কার্বনডাইঅক্সাইড পরিবহন।


HCO3 রক্তের লোহিত রক্তকণিকায় K+ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পটাশিয়াম বাইকার্বনেট (KHCO3) গঠন করে। কিছু HCO3 লোহিত রক্তকণিকা হতে বের হয়ে রক্তরসে চলে আসে এবং Na+ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোডিয়াম বাইকার্বনেট (NaHCO3 ) গঠন করে।

এভাবে সৃষ্ট KHCO3 ও NaHCO3 রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়। লোহিত রক্তকণিকা থেকে যতটি HCO3 রক্তরসে আসে ততটি CI রক্তরস থেকে লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। একে ক্লোরাইড শিফট বিক্রিয়া বা হ্যামবার্জার বিক্রিয়া (Chloride shift reaction or Hamburger’s reaction) বলা হয়।

লোহিত রক্তকণিকা থেকে বাইকার্বনেট আয়ন রক্তরসে প্রবেশ করার ফলে ভারসাম্য রক্ষার জন্য ক্লোরাইড আয়ন রক্তরস থেকে লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। এর গুলো রক্তে অম্ল-ক্ষার (pH – 7.4) ভারসাম্য বজায় থাকে।

ক্লোরাইড শিফট বিক্রিয়া বা হ্যামবার্জার বিক্রিয়া কী?

কিছু HCO3 লোহিত রক্তকণিকা হতে বের হয়ে রক্তরসে চলে আসে এবং Na+ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোডিয়াম বাইকার্বনেট (NaHCO3 ) গঠন করে।
এভাবে সৃষ্ট KHCO3 ও NaHCO3 রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়। লোহিত রক্তকণিকা থেকে যতটি HCO3 রক্তরসে আসে ততটি CI রক্তরস থেকে লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। একে ক্লোরাইড শিফট বিক্রিয়া বা হ্যামবার্জার বিক্রিয়া (Chloride shift reaction or Hamburger’s reaction) বলা হয়।

ক্লোরাইড শিফটিং বিক্রিয়া বা হ্যামবার্জার বিক্রিয়া
ক্লোরাইড শিফটিং বিক্রিয়া বা হ্যামবার্জার বিক্রিয়া।

Leave a Comment