রুই মাছের শ্রেণিবিন্যাস, স্বভাব, বাসস্থান। রুই মাছের বাহ্যিক গঠন।

রুই মাছ/ Labeo rohita

রুই মাছ বাংলাদেশ তথা এশিয়া অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের একটি সাধারণ মাছ। এদেরকে মেজর কার্প বলা হয়। কার্প জাতীয় মাছ বলতে সেই সমস্ত মাছকে বোঝায় যাদের অন্তঃকঙ্কাল অস্থি দ্বারা তৈরি মস্তক আঁইশবিহীন এবং অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গবিহীন। আমাদের দেশে রুই অর্থাৎ Labeo rohita মাছের চাহিদা অনেক বেশি।

রুই মাছের শ্রেণিবিন্যাস

  • Phylum : Chordata
  • Subphylum : Vertebrata
  • Class : Osteichthyes
  • Subclass : Actinopterygii
  • Order : Cypriniformes
  • Family : Cyprinidae
  • Genus : Labeo
  • Species : Labeo rohita

রুই মাছের স্বভাব ও বাসস্থান (Habit & Habitat)

স্বাদু পানির জলাশয় বিশেষ করে পুকুর, হ্রদ, নদী, খাল, বিল, হাওর-বাওর প্রভৃতিতে Labeo rohita পাওয়া যায়। রুই মাছ তৃণভোজী স্বভাবের। দুই থেকে তিন বছর বয়সে এরা যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। জুন-জুলাই মাসে প্রবাহমান জলাশয়ে এরা ডিম পাড়ে। হালদা নদী রুই মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে গণ্য। বর্তমানে হ্যাচারী বা মৎস্য খামারে প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে রুই মাছের বাণিজ্যিক চাষ করা হয়। রুই মাছ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়।

রুই মাছের বাহ্যিক গঠন

 রুই মাছের দেহ মাকু সদৃশ (Spindle shaped) অর্থাৎ মধ্যভাগ মোটা ও দুই প্রান্ত ক্রমশ সরু, প্রস্থ থেকে উচ্চতা বেশি। চলনের সময় পানির ভিতর গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় না বলে এ ধরনের আকৃতিকে স্ট্রিমলাইনড (Streamlined) বলে। দেহের পৃষ্ঠভাগ কালো বর্ণের এবং পার্শ্ব অঙ্কভাগ রূপালি সাদা বর্ণের। পূর্ণাঙ্গ রুই মাছ ১৫-২৫ কেজি ওজন বিশিষ্ট হয়।

রুই মাছের বাহ্যিক গঠন

রুই মাছের দেহকে মস্তক বা মাথা (Head), ধড় বা দেহকাণ্ড (trunk), লেজ বা পুচ্ছ (tail) এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

রুইমাছের মাথার গঠন

দেহের অগ্রপ্রান্ত হতে কানকুয়ার পশ্চাৎ প্রান্ত পর্যন্ত অংশকে মস্তক বলে। উদর থেকে মস্তকের উপরিভাগ বেশি উত্তল। থুঁতনী (snout) ভোঁতা, নিচু, কদাচিত স্ফীত। মুখ নিচের দিকে অবস্থিত, আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত। মুখছিদ্রের পিছনে কোনো পাতা (eye lids) নেই, কর্নিয়া স্বচ্ছ চামড়ার আস্তরণ দ্বারা আবৃত থাকে। মুখের উপরের চোয়ালে একজোড়া খাটো ও সরু বার্বেল অবস্থিত।

এদেরকে ম্যাক্সিলারি বার্বেল (maxillary barbel) বলে। এরা সংবেদী অঙ্গ হিসেবে কাজ করে। মস্তকের প্রতিপার্শ্বে একটা বৃহৎ ফুলকা প্রকোষ্ঠ থাকে। এতে চিরুনীর ন্যায় চারটি ফুলকা থাকে। ফুলকা প্রকোষ্ঠটি কানকুয়া (operculum) নামে পরিচিত। কানকুয়ার নিচের কিনারায় ব্রাঙ্কিওস্টিগাল (branchiostegal) পর্দা ফুলকা প্রকোষ্ঠের বড় ছিদ্রকে ঢেকে রাখে।

রুইমাছের দেহকাণ্ড (Trunk)

মস্তক ও লেজের মধ্যবর্তী প্রশস্ত অংশটি দেহকাণ্ড। দেহকাণ্ড অস্থিময় সাইক্লয়েড আঁইশ দ্বারা নিবিড়ভাবে আবৃত থাকে। দেহকাণ্ডের উভয় পার্শ্বে একটি করে পার্শ্ব রেখা (Lateral line) দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। দেহকাণ্ডের পৃষ্ঠ দিকে একটি পৃষ্ঠ পাখনা (Dorsal fin) পার্শ্বদিকে কানকুয়ার পিছনে একজোড়া বক্ষ পাখনা (pectoral fin), দেহকাণ্ডের মাঝামাঝি একজোড়া শ্রোণি পাখনা (pelvic fin) ও লেজ সংলগড়ব পায়ু পাখনা (anal fin) থাকে।

দেহকাণ্ডের পিছনের দিকে মধ্যঅঙ্কীয় দিকে তিনটি ছোট ছিদ্র পর পর অবস্থান করে থাকে। ছিদ্রগুলো হলো- পায়ুছিদ্র, জননছিদ্র ও রেচনছিদ্র।

রুইমাছের লেজ (Tail)

রুই মাছের পায়ুর পিছনের অংশকে লেজ বলে। লেজকে পরিবৃত্ত করে পুচ্ছ পাখনা (caudal) থাকে। পুচ্ছ পাখনা হোমোসার্কাল (homocercal) প্রকৃতির অর্থাৎ দুটি সমখণ্ডকে বিভক্ত। পুচ্ছ পাখনাই রুই মাছের একমাত্র চলন অঙ্গ।

রুইমাছের আঁইশ (Scale)

রুই মাছের দেহত্বক অস্থিময় কতগুলো পাত সদৃশ্য গঠন দ্বারা আবৃত থাকে, এদেরকে আঁইশ বলে। রুই মাছের দেহ সাইক্লয়েড আঁইশ (Cycloid scale) দ্বারা আবৃত থাকে। এগুলো সাধারণত গোলাকার ও রূপালী বর্ণের হয়ে থাকে। আঁইশের কেন্দ্রস্থলে ফোকাস রেখা থাকে। আঁইশের কেন্দ্রস্থলকে ফোকাস বলে। আঁইশের কেন্দ্রকে ঘিরে ঘন সন্নিবিষ্ট কতগুলো রেখা থাকে। এগুলোকে সার্কুলি (circuli) বলে। আঁইশে সার্কুলিগুলোর মাঝে গাঢ় বর্ণের বৃদ্ধি রেখা অর্থাৎ অ্যানুলি (একবচনে অ্যানুলাস) থাকে, যেগুলোর সংখ্যা প্রতিবছর একটি করে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

রুইমাছের-আঁইশ এর গঠন। সাইক্লয়েড আঁইশ।

এগুলো গণনা করে মাছের বয়স নির্ধারণ করা হয়। রাসায়নিকভাবে আঁইশগুলো চুন ও কোলাজেন তন্তু নিয়ে গঠিত। এরা চলনের সময় পানির বাধা হ্রাস করে। তাছাড়া শ্রেণিবিন্যাস ও বয়স নির্ণয়ে এরা ভূমিকা রাখে।

রুই মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস

রুই মাছ শাকাশী। এরা সাধারণত জলাশয়ের মধ্যস্তরে খাবার খায়। ছোট অবস্থায় রুই মাছের প্রধান খাদ্য হচ্ছে Zooplankton এবং বয়স্করা Phytoplankton খেয়ে বাঁচে। রুই মাছের মুখ কিছুটা নিচের দিকে নামানো এবং ঠোঁট পুরু থাকার কারণে মাঝে মাঝে এরা পানির তলদেশ থেকে পঁচা জৈব পদার্থ খেয়ে জীবনধারণ করে। এছাড়া ফিসমিল (Fish meal), খৈলের গুঁড়া, কুঁড়া ইত্যাদি পুকুরে চাষের সময় সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বয়স্ক রুই মাছ মাঝে মাঝে কাঁদা ও বালি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

Leave a Comment